লৌহজং প্রতিবেদক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ টাঙ্গাইলের খন্দকার তালহার (১৭) চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার মা। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তার সঠিক চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা না পেলে তার পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তালহা শহরের হাজী আবুল হোসেন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের (ভোকেশনাল) নবম শ্রেণির ছাত্র। সে পৌর এলাকার বেড়াবুচনা সবুজবাগ এলাকায় তার নানার ভিটায় মায় ও ছোট বোন নিয়ে থাকেন। তার বাবা খন্দকার আশরাফ। ১৫ বছর আগে মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর তার বাবা অন্যত্র বিয়ে করে চলে যান।
তারপর থেকে অন্যের বাসায় কাজ করে ও হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে দুই সন্তান নিয়ে কোন রকম সংসার চলছিল। কিছু জমানো টাকা ছিল তা চিকিৎসা করিয়ে শেষ হয়ে গেছে। এমতো অবস্থায় ছেলের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে তার মা।
আরও জানা যায়, তালহার একমাত্র ছোট বোন আবুল হোসেন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। অভাবের সংসারে তালহা মাঝখানে পড়াশোনা বাদ দিয়ে রংয়ের কাজ শুরু করেন। পরে আবার ওই বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বর্তমানে পড়াশোনা পাশাপাশি আবার রংয়ের কাজ করে মায়ের সাথে সংসারের হাল ধরেছেন। গত ৫ অগাস্ট তালহা ও তার ছোট বোন টাঙ্গাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ নেয়।
আহত খন্দকার তালহার বলেন, আমি শুরু থেকেই আন্দোলনে ছিলাম। বিজয় মিছিলের দিন পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে। তখন পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। তখন আমি দৌঁড়ে আশ্রয় নেয় পাশে থাকা একটি ৬ তলা ভবনের ছাদে। দুইজন পুলিশ আমার পিছু নেয়। পরে তারা ওই ছাদে উঠে আমার বুকের মধ্যে বন্দুক ধরে। আমি ভয় পেয়ে যায় তখন বন্দুকটি বুক থেকে সরানোর জন্য ধস্তাধস্তি করি। এক পর্যায়ে বাম পায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পুলিশের কাছ থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করলে এক ছেলে এসে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমার পায়ের ভিতরে এখনো গুলির সিসা রয়েছে। একটি নক কেটে ফেলা হয়েছে। সেলাই করে দিয়েছিল ইনফেকশন হয়েছে। ভালো হতে আরও এক মাসের উপরে লাগবে। তারপর আবার অপারেশন করতে হবে। এখন এতো টাকা আমাদের কাছে নাই। অপারেশন না হলে হয়তো পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে। ৮-১০ টা ছেলের মতো আমিও স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে চাই। সবাই আমাকে সহযোগিতা করলে আমি ভালো হতে পারবো।
তালহার ছোট বোন খন্দকার সুমাইয়া আফরোজ বলেন, আমার ভাই ও আমি আন্দোলনের অংশগ্রহণ করি। একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। আমার ভাই যে গুলিবিদ্ধ হয়েছে তখন জানতাম না। বাড়িতে আসার পর অন্যদের কাছ থেকে জানতে পারি। ভাইয়ের পায়ে অপারেশন করতে হবে অনেক টাকার দরকার। আমার পারিবারিক অবস্থা ভালো না। সবাই সহযোগিতা করলে আমার ভাই সুস্থ হয়ে যাবে। নয় সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে।
তালহার মা কোহিনুর বেগম বলেন, দুটি সন্তান রেখে স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে বাবার ভিটায় থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সামান্য কিছু টাকা রোজগার করি। তা দিয়েই সংসার চালাচ্ছি ও ছেলে-মেয়ে পড়াশোনার খরচ দিচ্ছি। ছেলেও পড়াশোনার পাশাপাশি রং মিস্ত্রির কাজ করে। বিজয় মিছিলে ছেলের পায়ে পুলিশ গুলি করে। ধারদেনা করে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার উপরে শেষ করছি। আমার হাতে আর কোনো টাকা-পয়সা নাই। ডাক্তার বলেছে এখনো তালহার পায়ের বড় অপারেশন বাকি রয়েছে। অনেক টাকার দরকার।
তিনি বলেন, টাকার অভাবে ছেলের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না করেই হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাই। ছেলের পায়ে গুলির কিছু সিসা জাতীয় ধাতব ভেতরেই রয়ে গেছে। ওর অবস্থা খারাপ হতে থাকলে গত শনিবার আবার টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। ছেলের পায়ে ইনফেকশন হয়েছে। ডাক্তার বলছে ভালো হতে এক মাসের উপরে সময় লাগবে। তারপর পায়ের অপারেশন করে গুলি গুলো বের করতে হবে। এ অবস্থায় কীভাবে আমি সন্তানের চিকিৎসার ব্যয় মেটাবো তা নিয়ে চিন্তায় আছি। সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার ছেলেকে সহযোগিতা করলে। আমার ছেলে সুস্থ হয়ে যাবে।
কোহিনুর বেগম বলেন, গুলিতে তালহার বাঁ পায়ের একটি আঙুল কেটে ফেলা হয়েছে। আমার ছেলে আগের মত স্বাভাবিক না হলেও যেন নিজে একা একা চলাফেরা করতে পারে, সেই আশা নিয়ে সবার কাছে সহযোগিতা চাচ্ছি।
তালহার বৃদ্ধ নানি খাইরন বেগম বলেন, তাহলার উপর ভবিষ্যত নির্ভর করছে। ওর মা অন্যের বাসায় কাজ করে। তালহাও রংয়ের কাজ করে সংসার চালাচ্ছে তালহা ও ওর ছোট বোনের পড়াশোনা খরচ চালাচ্ছে। আর কতদিন ওর মা অন্যের বাসায় কাজ করবে। মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য তালহা পড়াশোনা পাশাপাশি কাজ করছে। ও ভালো না হলে দেখার মতো কেউ থাকবে না। সবাই সহযোগিতা করলে তালহা ভালো হয়ে আবার সংসারর হাল ধরতে পারবে।
টাঙ্গাইল পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মেহেদী হাসান আলীম বলেন, আমরা খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করছি। টানাটানির সংসারে গুলিবিদ্ধ ছেলেটা অসহায় হয়ে পড়ছে। আশপাশের মানুষ দুই-চারশ টাকা দেয়, সেই টাকা দিয়ে ব্যথার ওষুধ কিনে। পরিবারের যে অবস্থা, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করানো তাদের পক্ষে সম্ভব না।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রহিমা বেগম বলেন, ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে আসে ওইদিনই ওয়াশ করিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়। ইনফেকশন কন্ট্রোল হলে অপারেশন করা হবে।