নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল বাজারে সবুজ কর্ম উন্নয়ন সংস্থা নামধারী একটি এনজিও একাধিক শাখা খুলে নিয়ম বহির্ভূতভাবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছাড়াই চালাচ্ছে মাসিক কিস্তিসহ ক্ষুদ্র ঋণের চড়া সুদের ব্যবসা। রাষ্ট্রীয় তফসিলভুক্ত ব্যাংক ও সংস্থাগুলোর চেয়ে বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে এফডিআর করে হাতিয়ে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা। অনেক ভুক্তভোগীরা তাদের আমানত, সঞ্চয় ফেরত এবং ঋণ নিতে গেলে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টদের নাকের ডগায় এমআরএ সনদ ছাড়াই চড়া সুদে অনিয়ম করে এক যুগেরও বেশি সময় কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কারন হিসাবে সংশ্লিষ্টদের মনিটরিং ও উদাসীনতায়কেই দায়ী করছেন ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা। এখনই ওই নামধারী এনজিওর লাগাম টেনে না ধরলে চরম ক্ষতির আশংঙ্কা করছেন নানা শ্রেণি পেশার মানুষ।
সবুজ কর্ম উন্নয়ন সংস্থা নামের এনজিও ১৩ বছর আগে দেলদুয়ারের পাথরাইলে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে মালিকানা পরিবর্তন হলেও ৩টি শাখার কার্যক্রম বিদ্যমান। দেলদুয়ার ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় শাখা খুলে সহজ সরল দরিদ্র ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে বেশি লাভ দিবে বলে কৌশলে এফডিআর, ডিপিএস ও সঞ্চয় করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। উল্টো দিকে তাদের রাখা আমানত, সঞ্চয় ফেরত ও ঋণ নিতে গেলে হতে হচ্ছে নানা হয়রানির শিকার। যেখানে রাষ্ট্রীয় তফসিলভুক্ত ব্যাংক ও সংস্থাগুলো আমানত, সঞ্চয়ের মুনাফা দিচ্ছেন প্রতি লাখে ৮’শ ৭৪ টাকা। সেখানে ওই এনজিও লাখে দুই হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি দেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্ষুদ্রঋণ বিভাগকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে আনতেই মূলত সংস্থাটির সৃষ্টি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ সামাজিক সেবা নামক প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র্রঋণ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এসে এ খাতের উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণের গুরত্ব দেখা দেয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষুদ্র্রঋণ গবেষণা ইউনিট গঠন করে। ২০০৬ সালে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি আইন, ২০০৬ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি বিধিমালা– ২০১০, আমানতকারী নিরাপত্তা তহবিল বিধিমালা, ২০১৪, ক্ষুদ্রঋণ তথ্য বিধিমালা, ২০২০ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে জেলার প্রায় ৩ থেকে ৪টি সমাজসেবা অফিসের রেজিস্ট্রেশন নেওয়া সমিতি হাজার হাজার গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জেলার হাজার হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ। এমআরএ সনদ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াও অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে কর্তৃপক্ষের।
সমাজসেবা অধিদফতর বর্তমানে ১০৩২টি কার্যালয়ের মাধ্যমে ৫৪টি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলো হচ্ছে, দারিদ্র নিরসন কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি, শিশু সুরক্ষামূলক কার্যক্রম, সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, প্রতিবন্ধিতা সহায়ক সামগ্রী উৎপাদন কেন্দ্র্র, সেবামূলক ও কমিউনিটি ক্ষমতায়ন কার্যক্রম।
সবুজ কর্ম উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রিপন খান বলেন, কোন সংস্থাই শুরুতেই এমআরএ সনদ পায় না। আমরা জেনে শুনেই ঋণদান ও দীর্ঘ মেয়াদী সঞ্চয় গ্রহন করে থাকি। প্রায় সকলেই সমাজসেবা থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। সমাজসেবা অফিস থেকে অডিট করা হয় ও তাদের নির্দেশক্রমে আমরা সংস্থা পরিচালনা করে আসছি। সমাজসেবা অফিসের গঠনতন্ত্রে ঋণদান ও সঞ্চয় গ্রহন করা যায় এমন কোন নির্দেশনা আছে কি প্রতিবেদকের এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি তিনি।
এ বিষয়ে দেলদুয়ার উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছাড়া সমাজসেবার কোন সংস্থা ঋণদান ও সঞ্চয় গ্রহন করতে পারবে না। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ধরনের কার্যক্রম যারা পরিচালনা করবে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
উল্লেখ্য, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন, ২০০৬ এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী এমআরএ সনদ ছাড়া কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নেই। একই আইনের ৩৫ (১) (ক) ধারা অনুযায়ী এমআরএ’র সনদ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়া ২০২০ সালের ৩০ জুনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এমআরএ সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২১ হাজার শাখা ও প্রায় ২ লাখ জনবল রয়েছে। এদের মাধ্যমে ৩ কোটি ৩৩ লাখ গ্রাহকের মাঝে মাঝে বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হয়েছে। গ্রাহকের মধ্যে ৯১ শতাংশ হচ্ছে নারী। এ সময় গ্রাহকের বার্ষিক সঞ্চয় প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা।